অন্যান্য

ছোট গল্প সহযাত্রী

  রোকসানা পারভীন ১৮ মার্চ ২০২৩ , ১০:০৯:১১ প্রিন্ট সংস্করণ

পড়ন্ত বিকেলে কোলাহল মুখর ব্যস্ত রাস্তার পাশে বাসের টিকেট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে রুমানা। একটা বাস আসছে তো লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে উঠার জন্য। কার আগে কে উঠবে সেই প্রতিযোগিতা। রুমানারও এভাবেই প্রতিদিন প্রতিযোগিতা করেই বাসে উঠতে হয় সকাল সন্ধ্যায়। তবে প্রতিদিন এক স্টপেজ থেকে না। কাজের সুবাদে তাকে যেতে হয় ঢাকা শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। রুমানা চাকরি করে একটা কর্পোরেট অফিসে অডিট ডিপার্টমেন্টে। তাই ইচ্ছে থাকলেও নিজের অফিস কক্ষের চেয়ারটাতে বসার সুযোগ তার খুব একটা হয় না।
রুমানা টিকেট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আজ তার হুলুস্থুল করে গাড়ীতে উঠতে ইচ্ছে করছে না বলেই পর পর দুটি বাস চলে গেল তার সামনে দিয়ে। বিষয়টি কাউন্টারে বসে থাকা ছেলেটির নজর এড়ায়নি। সে পরবর্তী বাস আসার সাথে সাথে আপা আসেন বলেই নিজে উঠে এসেছে তাকে বাসে উঠতে সাহায্য করার জন্য। সে জোরে জোরে হেল্পারকে বলছে ” আপারে বসার জন্য একটা সীটের ব্যবস্থা করে দিস।” ঘটনাটা খুব ছোট কিন্তু রুমানার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার জন্য টনিকের মতো কাজ করে। সে বাসের হাতল ধরে দাঁড়াতেই অল্প বয়স্ক এক তরুণ তার পাশের সীটটি থেকে সরে গিয়ে বলে ” এখানে বসতে পারেন।” রুমানা সীটে বসতে বসতে ছেলেটাকে ধন্যবাদ জানায়। ছেলেটা হেসে বলে ধন্যবাদের কিছু নেই । আমার পাশের সীটটা খালি ছিল বলেই আপনি বসেছেন। তারপর জিজ্ঞেস করে এই রাস্তায় প্রতিদিনই যাতায়াত করেন?
রুমানা না সূচক মাথা নেড়ে বলে ” না প্রতিদিন না। তবে মাঝে মাঝে আসা হয় অফিস থেকে ।” ছেলেটা ও আচ্ছা বুঝতে পারছি আপনি চাকুরী করেন। তারপর নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে ” আমি রাইয়ান। এখনো ছাত্রের তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে পারিনি। ” রুমানা হেসে বলে আপনি তো এখনো অনেক ছোট। কোথায় পড়াশোনা করছেন?” রাইয়ান বলে আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষে আছি। এখনো শেষ পরীক্ষা দিতে চার মাস বাকী। আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন। আপনি কি মোহাম্মদপুরে যাবেন! রুমানার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রাইয়ান বলে আমার বাসাও মোহাম্মদপুরে। এসেছিলাম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। এই পূর্ণিমার রাতে বন্ধুরা মিলে যাবো বুড়িগঙ্গায় নৌবিহারে তারই প্লান করতে। খুব কাছ থেকে প্রকৃতিকে দেখবো প্রান ভরে। হয়তো দু একটা কবিতাও বেরিয়ে আসতে পারে। ” রুমানা খুব অবাক হয় রাইয়ানের এতো সাবলীলভাবে কথা বলা দেখে। যাকে সে চিনে না জানে না সে কিভাবে এতো কথা বলতে পারে! রুমানাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাইয়ান বলে ” আপনি কবিতা পড়েন?” রুমানা বলে অনেক আগে পড়তাম কিন্তু এখন আর সময়ের অভাবে পড়া হয় না। বাসা , বাচ্চা আর অফিস করে সময় কোথায় কবিতা পড়ার!” রাইয়ান যেন প্রসংগ খুঁজে পায় কথা বলার। সে বলে ” আপনার বাচ্চা আছে? আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না। রুমানা এককথায় হেসে উত্তর দেয় হাঁ বাচ্চা আছে। তারপর চোখ বন্ধ করে। আসলে এই অচেনা ছেলেটার সাথে বকবক করতে তার একদমই ভাল লাগছিল না। তাই চোখ বন্ধ করে ছেলেটাকে এভোয়েড করার চেষ্টা করতে করতে কখন যে সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। রুমানার ঘুম ভাঙে রাইয়ানের ডাকে। ” এই যে শুনছেন! আমাকে নামতে হলে তো আপনাকে এখন উঠতে হবে ।” রুমানা ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বলে ” সরি শরীর ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাকেও তো এই স্টপেজে নামতে হবে। ধন্যবাদ ঠিক সময়ে ডাকার জন্য।”

রুমানা বাস থেকে নেমেই এদিক ওদিক তাকাতে থাকে খালি রিক্সার জন্য। রাস্তায় তেমন লাইট না থাকায় সন্ধ্যাতেই মনে হচ্ছে রাত নেমে গেছে। রাইয়ানও নেমেছে ওখানেই। সেও দাঁড়িয়ে আছে রুমানার পাশে। রুমানা ভেবেছে সে হয়ত দাঁড়িয়ে আছে একটা খালি রিক্সার আশায়। তাই সে জিগ্যেস করে “আপনি কোথায় যাবেন?” রাইয়ান ঝটপট উত্তর দেয় “ আমার বাসা কাছেই। আমি হেঁটেই বাসায় যাবো। আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনার রিক্সার জন্য। জায়গাটা অন্ধকার। আপনাকে একা এখানে রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই দাঁড়িয়ে আছি। আপনি কি আমার কথা শুনে ভাবছেন এই ছেলেটা কি বাচাল প্রকৃতির? অপরিচিত একটা মেয়ের সাথে এত কথা বলছে কেন?”
রুমানা মনে মনে ঠিক এই কথাটা চিন্তা করলেও মাথা নেড়ে বলে “না না আমি এগুলো কিছুই মনে করিনি।”
একটু চুপ করে থেকে রাইয়ান বলে, আমি কিন্তু সহজে এত কথা বলি না । কিন্তু আপনাকে কেন যেন খুব চেনা আর আপন মনে হল । আমার কোন বোন নেই। তাই হয়ত কোন কিছুর হিসাব না করেই এত কথা বলেছি। আমি কি আপনার ফোন নাম্বারটা পেতে পারি?”
রুমানা কোন দ্বিধা ছাড়াই মোবাইল নাম্বারটা দেয়।

কর্মব্যস্ত রুমানা ঘরে ঢুকলেই বাইরের দুনিয়া ভুলে যায় বাচ্চা আর বাসা সামলাতে সামলাতে। আর অফিসে গেলে বিভিন্ন ফ্যাক্টরীর অডিট রিপোর্ট আর বাইয়ার রিকোইয়ারমেন্ট দেখতে দেখতেই কোথা দিয়ে সময় দৌড়ে পার হয় টের পায় না সে। তাই স্বাভাবিকভাবেই রাইয়ানের কথাও ভুলে যায়।

একদিন অফিসে বসে কিছু কাজ করছিল রুমানা। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে অপরিচিত নাম্বার। সে কলটা রিসিভ করে জিজ্ঞেস করে “হ্যালো! কে বলেছেন?”
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে ” আমি রাইয়ান। এটা কি রুমানা আফসানার নাম্বার? আমি কি তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?”
রুমানা ঠিক মনে করতে পারছে না রাইয়ানটা কে? তারপরও বলে ” আমিই রুমানা। ” রাইয়ান বুঝতে পেরে বলে আপনি মনে হয় আমাকে চিনতে পারছেন না। আপনার সাথে আমার বাসে পরিচয় হয়েছিল। আপনি আমাকে আপনার নাম্বারটা দিয়েছিলেন।”
রুমানা তাড়াতাড়ি বলে ” হ্যা হ্যা এখন চিনতে পারছি। আসলে তোমার ফোন নাম্বার তো আমার নেয়া হয়নি। কেমন আছো তুমি? তুমি করে বলছি । কিছু মনে করছো না তো! ”
রাইয়ান বলে “আপনি তো তুমি করেই বলবেন। কিছু মনে করবো কেন? আমার পরীক্ষাটা শেষ হলো কাল। আপনার কথা মনে হলো তাই ফোন দিয়েছি।”
রুমানা স্বাভাবিক ভাবে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দেয়। আসলে সেদিন রাইয়ান যখন বাস থেকে নেমে বলেছিল ওর কোন বোন নেই তখন থেকেই ওর প্রতি একটা সফট কর্নার সৃষ্টি হয়েছে রুমানার। ও রাইয়ানকে ছোট ভাই হিসেবেই দেখছে।

রাইয়ানের হাতে তেমন কোন কাজ না থাকায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা, লেখালেখি আর হুটহাট করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটছে ওর । ইন্টার্নি শুরু হলে আবার ব্যস্ততা বেড়ে যাবে। ওর বাবা মায়ের ইচ্ছা ইন্টার্নি শেষ হলে ছেলে ইংল্যান্ডে গিয়ে কোন একটি ডিগ্রি নিয়ে এসে বাংলাদেশেই প্রাকটিস করবে। রাইয়ানের বাবা মা দুজনেই বেসরকারি ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ঢাকায় নিজেদের বাড়ী আছে। তাই আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল।

রাইয়ান এখন মাঝে মাঝেই রুমানাকে ফোন দেয়। রুমানার সময় থাকলে খুব সহজভাবে গল্প করে। ওর বাবা মায়ের কথা বলে। বন্ধুদের কথা বলে। লেখালেখির কথা বলে। মাঝে মাঝে দু একটা রোমান্টিক কবিতাও পাঠায় রুমানাকে। দিন দিন ওদের মধ্যে খুব ভাল একটা বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। রুমানা একটা বিষয় খেয়াল করে রাইয়ান কখনো আপা শব্দটা ব্যবহার করে না। শুধু আপনি আপনি বলেই কথা চালিয়ে যায়। কিন্তু সে কখনো কিছু জিজ্ঞেসও করে না এ ব্যাপারে।

সেদিন রুমানা কাজ প্রায় শেষ করে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়বে। এমন সময় রাইয়ানের ফোন আসে। ” আপনার কি একটু সময় হবে! আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

রুমানা বলে ” আমি এখন অফিস থেকে বের হবো। তুমি বল। আমি শুনছি।”
“আমি আপনার অফিসের সামনেই আছি। আপনি আসুন।” রাইয়ানের কথায় আজ কোন উচ্ছলতা নেই। কেমন যেন কঠিন শোনায়।
রুমানা অফিসের গেট দিয়ে বেরিয়েই দেখে রাইয়ান একটা হোন্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমানা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ” কি খবর তোমার? নতুন হোন্ডা কিনে কি আমাকে দেখাতে এসেছো?”
রাইয়ান এসব কথার কোন উত্তর না দিয়ে বলে ” আমার মন ভাল নেই। আপনার সাথে কথা বলা জরুরি। আপনি আমার পিছনে বসুন প্লিজ। ”
রাইয়ানের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। রুমানা কথা না বাড়িয়ে বাধ্য মেয়ের মতো উঠে বসে তার পিছনে। সে খুব চিন্তায় পড়ে যায়। কি বলবে রাইয়ান! তার মাথা কাজ করে না।

রাইয়ান সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে হোন্ডা থামায়। সে রুমানাকে নামতে বলে সামনে আগায়। তারপর একটু সামনে এগিয়েই সবুজ ঘাসে বসে পড়ে। রুমানা ও তার পাশে গিয়ে বসে। বলে “এবার বল তোমার মন খারাপ কেন? প্রেমিকার সাথে ঝগড়া হয়েছে?”
” আমার কোন প্রেমিকা নেই। আমি আপনাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। সেটা আমার কলেজ সাময়িকীতে ছেপেছে। সেখানে আমি আমার জীবনের সত্যি ভালবাসার কথা লিখেছি। রুমানা তুমি কি বুঝতে পারছো না আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি! ভালবাসি! আমি এই কথাটা তোমাকে জানানোর জন্য কতদিন ধরে ছটফট করছি! আজ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না বলেই এখানে এভাবে কথাগুলো বললাম।”

রুমানার ওর কথাগুলো শুনার পর যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। কিন্তু মনে হচ্ছে তাকে তো তার অবস্থান থেকে কিছু বলতেই হবে। তাই সে খুব আস্তে আস্তে বলে ” আমি কখনো এভাবে ভাবিনি। তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখি। আমার স্বামী আছে। বাচ্চা আছে। তোমার বয়স অনেক কম। তোমার পুরো ভবিষ্যৎ সামনে পড়ে আছে। তোমার বাবা মা তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তুমি কেন তাদের স্বপ্নকে ভেঙে দিবে?আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। তুমি চাইলে আমি নিজে তোমার জন্য মেয়ে খুঁজবো। আমার বিশ্বাস তোমার জন্য ভীষণ ভালো একটা মেয়ে অপেক্ষায় আছে।” রাইয়ান রুমানার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনে।

রাইয়ান আর কোন কথা না বাড়িয়ে রুমানাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। যাওয়ার সময় তার দিকে না তাকিয়েই ভালো থেকো বলে দ্রুত হোন্ডা চালিয়ে চলে যায়। রুমানার ভীষণ খারাপ লাগে রাইয়ানের জন্য। সে যে রাইয়ানকে চিনতো আজকের রাইয়ানের সাথে তার বিস্তর ফারাক। রুমানার চোখ বাঁধ মানে না। সে অশ্রুসজল নয়নে বেশ কিছুক্ষণ রাইয়ানের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বাসায় ঢুকে।

রাইয়ানের কথাগুলো রুমানাকে ভিতরে ভিতরে একদম এলোমেলো করে দিয়েছে। সারারাত সে ঘুমাতে পারেনি। সমাজ আর বাস্তবতাকে সে অগ্রাহ্য করবে কি করে!
তাই খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠেছে সে। সকালের নাস্তা রেডি করে এক কাপ চা হাতে নিয়ে পেপার খুলে বসেছে। কিন্তু পেপার আর পড়া হয় না রুমানার। প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম শিরোনাম দেখেই তার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে যায়।

গল্প সংকলনঃ অদ্বৈত

 

আরও খবর

Sponsered content