জাতীয়

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ

  অনলাইন ডেষ্ক ৭ মার্চ ২০২৩ , ১১:২৮:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে, রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল, হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। কবি নির্মলেন্দু গুণ এভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে বর্ণনা করেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হতে যে ভাষণে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে মুক্তির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি জাতি, সেই জাদুকরী ভাষণের দিন আজ। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এদিন অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির স্বাধীনতা-মুক্তি ও জাতীয়তাবোধ জাগরণের মহাকাব্য, বাঙালি তথা বিশ্বের সকল লাঞ্ছিত-বঞ্চিত নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির সনদ। ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের চূড়ান্ত প্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক দলিল এবং বিশ্বে সর্বাধিকবার প্রচারিত ও শ্রবণকৃত ভাষণ। এদিন লাখো মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চ দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ পরবর্তীতে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে পড়ে। একইভাবে এ ভাষণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলিলই নয়, জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয় বিধানের একটি সম্ভাবনাও তৈরি করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর এই বজ্রনিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষে। ১৯৭০ সালে বাঙালির প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বিজয়ী আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নানামুখী ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনো ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু ১ মার্চ এ অধিবেশন অপ্রত্যাশিতভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালন করে। এই পটভূমিতে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতায় তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে এবং বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে অফুরন্ত শক্তি ও সাহস যুগিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। লাখো মানুষের গগন বিদারী শ্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত্ পত্ করে ওড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। শপথের লক্ষ বজ্রমুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে। সেদিন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার ওপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লাখো বাঙালির ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। তিনি দরাজ গলায় তার ভাষণ শুরু করেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…।’ এরপর জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার মহাকাব্যের কবি ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা। মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণ। এই স্বল্প সময়ে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। তিনি তার ভাষণে সামরিক আইন প্রত্যাহার, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, গোলাগুলি ও হত্যা বন্ধ করে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বিভিন্ন স্থানের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, আমি বাংলা মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজও আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত। তিনি বলেন, ‘আমি বলে দিতে চাই; আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনও কর্মচারী অফিসে যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সর্বশেষ দু’টি বাক্য, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিক-নির্দেশনা ও প্রেরণার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা’।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছেন। রণকৌশলের দিক থেকে এই ভাষণ অসাধারণ। এই বক্তৃতা এখনও মানুষকে শিহরিত করে। এই বক্তৃতার আগে রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে যে পাকিস্তানি সেনা শাসকরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাবে, সে বিষয়েও তিনি অবহিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এবং সেই সভায় উপস্থিত তোফায়েল আহমেদ একটি নিবন্ধে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তার চশমাটা সেদিন ডায়াসের ওপর রেখে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার পুরোটাই অলিখিত। একদিকে তিনি পাকিস্তানীদের প্রতি চার দফা শর্ত আরোপ করলেন, অন্যদিকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বললেন। ভাতে মারার কথা বললেন, পানিতে মারার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। একজন তাকে বললেন, জনগণ কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া মানবে না। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি তোমার কাজ কর। আমি তাদের নেতা, আমি তাদের পরিচালিত করবো, তারা আমাকে নয়। রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান নয়, এটি সব জাতির মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিক-নির্দেশনা। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

আরও খবর

Sponsered content

আরও খবর: জাতীয়

ঘটনাস্থল: ঢাকার উত্তরখান ॥॥ সন্ত্রাসী মোঃ আশিক মিয়ার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী নিরীহ মোঃ নুরুল হকের প্রায় ১৩০০ অযুতাংশ জমি অবৈধ দখলে রেখেছে ॥॥ প্রাণের ভয়ে আদালতে যেতে পারছেন না তিনি

শীর্ষ সন্ত্রাসী মোঃ সোহেল রেজার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ

রূপালী ব্যাংক লোকাল অফিসের মহাব্যবস্থাপক কর্তৃক আত্মসাৎকৃত প্রায় ৪১ লাখ টাকার এফ ডি আর এর অভিযোগটি অর্থঋণ মোকাদ্দমা ৯৬/২০১৯ এ বিচারের জন্য নথিভূক্ত হয়েছে

সমরাস্ত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন করলেন প্রধানমন্ত্রী

ভারতীয় হার্ট বিশেষজ্ঞ || ডাঃ শ্বঙ্খ শুভ্র দাস চিকিৎসা সেবার পেশাদারিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে

ফরিদপুর চুনাখাটা দাখিল মাদ্রাসা ॥॥ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হয়েও নিয়োগ পাচ্ছে না নিরাপত্তা কর্মী ও সুপার পদের প্রার্থী ॥॥ প্রতিবন্ধকতা কার?ঘটনাটি তদন্ত প্রয়োজন